ইংরেজ শাসন আমলে বাংলায় প্রতিরোধ, নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - NCTB BOOK

বাংলার কৃষক একসময়ে সূর্য ওঠা ভোরে লাঙ্গল কাঁধে ছুটত তার ফসলের জমিতে । ফিরত অস্তগামী সূর্যকে সামনে রেখে । তার ঘরে অন্ন-বস্ত্রের প্রাচুর্য ছিল না, তবে অভাবও ছিল না । অভাব ছিল না আনন্দ-উৎসবের । বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। জারি, সারি, কীর্তন, যাত্রাপালা গানে জমে উঠত গ্রামবাংলার সন্ধ্যার আসর। কিন্তু, পনেরো শতকের শেষ দিকে ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের আগ্রাসী আগমন ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে থাকে বাংলার কৃষকের মুখের হাসি, তাদের আনন্দ-উৎসব । এরই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান ও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ।

প্রথমে তারা ধ্বংস করেছিল গ্রামবাংলার কুটির শিল্প, তারপর তাদের নজর পড়ে এদেশের উর্বর জমির ওপর। অতিরিক্ত অর্থের লোভে ভূমি রাজস্ব আদায়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে । যে পরীক্ষার নিষ্ঠুর বলি হয় বাংলার কৃষক-সাধারণ মানুষ । এ কারণে বিদ্রোহ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না তাদের। এ বিদ্রোহের সময়কাল ছিল আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষক আন্দোলন ব্যাপক রূপ নেয়।

একই সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিন্তার প্রভাব পড়ে এ সমাজের শিক্ষিত মহলে । ফলে, হিন্দু সমাজে যেমন শিল্প, সাহিত্যে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে, তেমনি উদ্ভব ঘটে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার। শুরু হয় কুসংস্কার, গোঁড়ামি দূর করে হিন্দুধর্মের সংস্কার। মুসলমান শিক্ষিত সমাজেও সংস্কারের মাধ্যমে তাদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে।
মূলত আঠারো ও উনিশ শতক জুড়ে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিতে এক নতুন ভাবধারার উন্মেষ ঘটে। এই পরিবর্তনের প্রথম সূচনা করে বাংলার কৃষক ও সাধারণ মানুষ ।

এই অধ্যায় শেষে আমরা-

  • ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারব;
  • নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনে বিশেষ ব্যক্তিবর্গের অবদান মূল্যায়ন করতে পারব;
  • ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হব;
  • বিভিন্ন সংস্কারক ও সংস্কার কর্মকাণ্ড জানার মাধ্যমে মুক্তচিন্তায় অনুপ্রাণিত হব ।
Content added || updated By

ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল একটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন । পলাশি যুদ্ধের পর থেকে এই আন্দোলনের শুরু। নবাব মীর কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের সাহায্য চান । এই ডাকে সাড়া দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসীরা নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করে । যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাশিম পালিয়ে গেলেও ফকির-সন্ন্যাসীরা তাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে । নবাবকে সাহায্য করার কারণে ইংরেজরা তাদের গতিবিধির প্রতি কড়া নজর রাখতে থাকে ।

চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী, ফকির-সন্ন্যাসীরা ভিক্ষাবৃত্তি বা মুষ্টি সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। ধর্মীয় উৎসব, তীর্থস্থান দর্শন উপলক্ষে সারা বছর তারা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াত । তাদের সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য নানা ধরনের হালকা অস্ত্র থাকত । বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তারা ছিল স্বাধীন এবং মুক্ত । কিন্তু, ইংরেজ সরকার তাদের অবাধ চলাফেরায় বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। তীর্থস্থান দর্শনের ওপর করারোপ করে, ভিক্ষা ও মুক্তি সংগ্রহকে বেআইনি ঘোষণা করে। তাছাড়া তাদের ডাকাত-দস্যু বলে আখ্যায়িত করতে থাকে । ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ফকির-সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয় । বিদ্রোহী ফকির দলের নেতার নাম ছিল মজনু শাহ। আর সন্ন্যাসীদের নেতার নাম ছিল ভবানী পাঠক। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়েব-গোমস্তার বাড়ি । ১৭৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে ।

১৭৭১ সালে মজনু শাহ উত্তর বাংলায় ইংরেজবিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। ১৭৭৭-১৭৮৬ সাল পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় ইংরেজদের সঙ্গে মজনু শাহ বহু সংঘর্ষে লিপ্ত হন। তাঁর যুদ্ধকৌশল ছিল গেরিলা পদ্ধতি অর্থাৎ অতর্কিতে আক্রমণ করে নিরাপদে সরে যাওয়া। ইংরেজদের পক্ষে তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা কখনই সম্ভব হয়নি। তিনি ১৭৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ, সোবান শাহ্, চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ্, মাদার বক্স প্রমুখ ফকির । এই নেভারা কয়েক বছর ইংরেজ প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। ১৮০০ সালে তাঁরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। অপরদিকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠক ১৭৮৭ সালে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ সৈন্যের আক্রমণে দুই সহকারীসহ নিহত হন। সন্ন্যাসী আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিনি । তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসী আন্দোলনেরও অবসান ঘটে ।

Content added By

তিতুমীরের সংগ্রাম

মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমির চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর ভারত ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যখন ওয়াহাবি আন্দোলনের জোয়ার চলছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে বারাসাত অঞ্চলে এই আন্দোলন তিতুমিরের নেতৃত্বে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে । উনিশ শতকে ভারতবর্ষে মুসলমান সমাজে এক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। বাংলায় তার দুইটি ধারা প্রবহমান ছিল । যার একটি ওয়াহাবি বা মুহাম্মদিয়া আন্দোলন, অপরটি ফরায়েজি আন্দোলন নামে খ্যাত। উভয় আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করে মুসলিম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ নির্দেশ করা। বাংলার ওয়াহাবিরা তিতুমিরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল। তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত তারিখ-ই-মুহাম্মদিয়া বা ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল উত্তর ভারতের সৈয়দ আহমদ শহীদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত।

তিতুমির হজ্ব করার জন্য মক্কা শরিফ যান। ১৮২৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ধর্ম সংস্কার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । তাঁর এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে বহু মুসলমান বিশেষ করে চব্বিশ পরগনা এবং নদীয়া জেলার বহু কৃষক, তাঁতি সাড়া দেয়। ফলে, জমিদাররা মুসলমান প্রজাদের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং তাদের প্রতি নির্যাতনমূলক আচরণ শুরু করে। তিতুমির এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে সুবিচার চেয়ে ব্যর্থ হন । শেষ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর অনুসারীরা সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ অবলম্বন করেন । ১৮৩১ সালে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমির তাঁর প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন । নির্মাণ করেন শক্তিশালী এক বাঁশের কেল্লা । গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন সুদক্ষ শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী ।

ইংরেজ, জমিদার, নীলকরদের দ্বারা নির্যাতিত কৃষকরা দলে দলে তিতুমিরের বাহিনীতে যোগ দিলে ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন একটি ব্যাপক কৃষক আন্দোলনে রূপ নেয় । ফলে শাসক-শোষক জমিদারশ্রেণি কৃষকদের সংঘবদ্ধতা এবং তিতুমিরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ সালে তিতুমিরের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার এক বিশাল সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। মেজর স্কটের নেতৃত্বে এই বাহিনী তিতুমিরের নারিকেলবাড়িয়া বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে । ইংরেজদের কামান-বন্দুকের সামনে বীরের মতো লড়াই করে পরাজিত হয় তিতুমিরের বাহিনী । তিনি যুদ্ধে নিহত হন। গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা উড়ে যায়। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে একটি সুসংগঠিত কৃষক আন্দোলনের । তিতুমির ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন । ইংরেজদের গোলাবারুদ, নীলকর, জমিদারদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে তাঁর বাঁশের কেল্লা ছিল দুঃসাহস আর দেশপ্রেমের প্রতীক। যা যুগে যুগে বাঙালিকে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহস জুগিয়েছে। উদ্বুদ্ধ করেছে দেশপ্রেমিক হতে, প্রেরণা জুগিয়েছে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে।

Content added || updated By

ইংরেজরা এদেশে এসেছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে । উপমহাদেশের শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে তারা এদেশের শাসক হয়ে ওঠে। তবে সব সময় তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল সজাগ । এই সজাগ ব্যবসায়িক বুদ্ধির কারণেই বাংলার উর্বর ফসলের ক্ষেতে তাদের দৃষ্টি পড়ে । তারা এই উর্বর ক্ষেতগুলোতে খাদ্য-ফসলের (খাবার ফসল) পরিবর্তে বাণিজ্য- ফসল (বাণিজ্যের জন্য যে ফসল) উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নীল ছিল তাদের সেই বাণিজ্যিক ফসল । ঐ সময়ে নীল ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক । বস্তুত বস্ত্র শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাপড় রং করার জন্য ব্রিটেনে নীলের চাহিদা খুব বেড়ে যায় । তাছাড়া আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে ইংরেজ বণিকদের সেখানকার নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে বাংলা হয়ে ওঠে নীল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্ৰ । ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে নীল চাষ শুরু হয়।

নীল চাষের জন্য নীলকরা কৃষকের সর্বোৎকৃষ্ট জমি বেছে নিত । কৃষকদের নীল চাষের জন্য অগ্রিম অর্থ গ্রহণে (দাদন) বাধ্য করা হতো । আর একবার এই দাদন গ্রহণ করলে সুদ-আসলে যতই কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করুক না কেন, বংশপরম্পরায় কোনো দিনই ঋণ শোধ হতো না । নীল চাষে কৃষকরা রাজি না হলে তাদের উপর চরম অত্যাচার চালানো হতো। বাংলাদেশে নীলের ব্যবসা ছিল একচেটিয়া ইংরেজ বণিকদের । ফরিদপুর, যশোর, ঢাকা, পাবনা, রাজশাহী, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে ব্যাপক নীল চাষ হতো । জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নীল চাষের খরচও বৃদ্ধি পায় । নীলকররা বিষয়টি বিবেচনায় রাখত না । তাছাড়া, প্রথম দিকে তারা চাষিদের বিনামূল্যে নীল বীজ সরবরাহ করলেও পরের দিকে তাও বন্ধ হয়ে যায় । ফলে নীল চাষ অব্যাহত রাখা চাষিদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

উপর্যুক্ত বঞ্চনার হাত থেকে চাষিদের বাঁচার কোনো উপায় ছিল না । আইন ছিল তাদের নাগালের বাইরে । আইন যারা প্রয়োগ করবেন, সেসব বিচারকের বেশির ভাগ ছিলেন নীলকরদের স্বদেশি বা বন্ধু । আবার নীলকররাও অনেক সময় নিজেরাই অবৈতনিক (অনারারি) ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পেতেন। ফলে, আইনের আশ্রয় বা সুবিচার পাওয়া চাষির জন্য ছিল অসম্ভব । এমতাবস্থায় নীলকর সাহেবরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ী রূপে নয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক অভিনব অত্যাচারী জমিদার রূপেও আত্মপ্রকাশ করে । এরা এতটাই নিষ্ঠুর আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, অবাধ্য নীলচাষিকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি ।

শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নীল চাষিরা ১৮৫৯ সালে প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়ে । গ্রামে গ্রামে কৃষকরা সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এসব বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নীলচাষিরাই। যশোরের নীল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নবীন মাধব ও বেণী মাধব নামে দুই ভাই । হুগলিতে নেতৃত্ব দেন বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার। নদীয়ায় ছিলেন মেঘনা সর্দার এবং নদীয়ার চৌগাছায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নামে দুই ভাই । স্থানীয় পর্যায়ের এই নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে । কৃষকরা নীল চাষ না করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এমনকি তারা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশও অগ্রাহ্য করে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশ করতে থাকে । বিভিন্ন পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি ছাপা হতে থাকে । দীনবন্ধু মিত্রের লেখা 'নীলদর্পণ' নাটকের কাহিনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

শেষ পর্যন্ত বাংলার সংগ্রামী কৃষকদের জয় হয় । ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার ইণ্ডিগো কমিশন’ বা ‘নীল কমিশন গঠন করে । এই কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে নীল চাষকে কৃষকদের ‘ইচ্ছাধীন' বলে ঘোষণা করা হয় । তাছাড়া ইন্ডিগো কন্ট্রাক্ট বাতিল হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নীল বিদ্রোহের অবসান হয় । পরবর্তীকালে নীলের বিকল্প কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হওয়ায় ১৮৯২ সালে এদেশে নীল চাষ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় ।

Content added By

ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহ বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার শাসশাইল গ্রামে ১৭৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর মক্কায় অবস্থান করেন । সেখানে তিনি ইসলাম ধর্মের ওপর লেখাপড়া করে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । দেশে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন যে, বাংলার মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে । তাদের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিনীতি, কুসংস্কার, অনাচার প্রবেশ করেছে । ইসলাম ধর্মকে কুসংস্কার আর অনাচারমুক্ত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন । এই প্রতিজ্ঞার বশবর্তী হয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তিনি এক ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। হাজী শরীয়তউল্লাহর এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের নামই 'ফরায়েজি আন্দোলন'।

‘ফরায়েজি’ শব্দটি আরবি 'ফরজ' (অবশ্য কর্তব্য) শব্দ থেকে এসেছে। যারা ফরজ পালন করেন তাঁরাই ফরায়েজি । আর বাংলায় যাঁরা হাজী শরীয়তউল্লাহর অনুসারী ছিলেন, ইতিহাসে শুধু তাদেরকেই ফরায়েজি বলা হয়ে থাকে । ইসলাম অননুমোদিত সব বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে যা অবশ্য করণীয়, তা পালন করার জন্য তিনি মুসলমান সমাজকে আহ্বান জানান । তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পারেননি। তিনি ইংরেজ রাজত্বকে ঘৃণার চোখে দেখতেন । তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব' অর্থাৎ ‘বিধর্মীর দেশ' বলে ঘোষণা করেন । তিনি বিধর্মী-বিজাতীয় শাসিত দেশে জুমা এবং দুই ঈদের নামাজ বর্জনের জন্য তাঁর অনুসারী মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বাংলার শোষিত, নির্যাতিত দরিদ্র রায়ত, কৃষক, তাঁতি, তেলি সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করেন । শরীয়তউল্লাহর ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আস্থা, বিশ্বাস, তাঁর অসাধারণ সাফল্য নিম্নশ্রেণির জনগণের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলে । মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে জমিদাররা বাধা প্রদান করতে থাকে । তিনি প্রজাদের অবৈধ কর দেয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন এবং জমিদারদের সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নেন । দেশজুড়ে অভাব দেখা দিলে তিনি নুন-ভাতের দাবিও উত্থাপন করেন ।

জমিদারশ্রেণি নানা অজুহাতে ফরায়েজি প্রজাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে প্রজাদের রক্ষার জন্য তিনি লাঠিয়াল বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৩৯ সালে তাঁর ওপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় । ১৮৪০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর মৃত্যুর পর ফরায়েজি আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর যোগ্য পুত্র মুহম্মদ মুহসিন উদ্দিন আহমদ ওরফে দুদু মিয়া। তিনি ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার মতো পণ্ডিত না হলেও তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ । দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন একাধারে ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি কৃষকশ্রেণির শোষণ মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয় । যার ফলে এই আন্দোলনের চরিত্র শেষ পর্যন্ত শুধু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না । ইংরেজ শাসকদের চরম অর্থনৈতিক শোষণে বিপর্যস্ত বাংলার কৃষক এই আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণবিরোধী প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। নীলকর সাহেবদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার কৃষক ও শত শত জমিদার ফরায়েজি আন্দোলনে যোগদান করেন।

দুদু মিয়া ছিলেন ফরায়েজিদের গুরু বা ওস্তাদ । পিতার মৃত্যুর পর তিনি শান্তিপ্রিয় নীতি পরিহার করে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন । ফরায়েজিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে দৃঢ় এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি নিজে লাঠি চালনা শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পিতার আমলের লাঠিয়াল জালালউদ্দিন মোল্লাকে সেনাপতি নিয়োগ করে তিনি এক সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের অবৈধ কর আরোপ এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা । এখানে উল্লেখ্য, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, যশোর, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি মুসলমানপ্রধান অঞ্চল নীল চাষের জন্য ছিল উৎকৃষ্ট । সুতরাং এ অঞ্চলে নীলকরদের অত্যাচারের মাত্রাও ছিল দুঃসহ । তাঁর নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে স্বাধীন সরকার গঠন করা হয়েছিল । কৃষক প্রজাসাধারণকে নিয়ে স্বাধীন সরকারের একটা সেনাবাহিনীও (লাঠিয়াল বাহিনী) গঠন করা হয়েছিল।

ফরায়েজিদের সরকার ব্যবস্থায় পূর্ব বাংলাকে কতকগুলো হলকা বা এলাকায় বিভক্ত করা হয় । দুদু মিয়া তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দীর্ঘকালব্যাপী জমিদার, নীলকর সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম চালিয়ে যান । দেশীয় জমিদাররা বিদেশি ইংরেজ সরকার ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে থাকে । কিন্তু দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষী না পেয়ে বারবার তাঁকে মুক্তি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলে ইংরেজ সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ভীত ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কোলকাতার কারাগারে আটকে রাখে । ১৮৬০ সালে তিনি মুক্তি পান এবং ১৮৬২ সালে এই দেশপ্রেমী বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে । তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

Content added || updated By

নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন

নবজাগরণ:
১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পর বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সূচনা হয় । আবার অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব এবং ফ্রান্সের ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ সালে) প্রভাবও এসে পড়ে এ অঞ্চলের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে । এ সময়ে বাংলার কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সংস্পর্শে আসেন । ইউরোপীয় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে এই শিক্ষিত বাঙালিদের মনে নবজাগরণের সূচনা হয়। তাঁরাই বাংলায় রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনা করেন। তাঁদের নেতৃত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে আত্মসচেতনা, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্রভাবে জাগ্রত হতে থাকে । নবজাগরণের প্রভাবেই শেষ পর্যন্ত এ দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাথমিক ভিত রচিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে তথা ভারতীয়দের স্বাধীনতার পথে নিয়ে যায় ।

এই সময়ে প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সামাজিক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে একধরনের চিন্তার বিপ্লব সূচিত হয় । এর পরিণতিতে উদ্ভব ঘটে নতুন ধর্মমত (ব্রাহ্ম ধর্ম ও নব হিন্দুবাদ), নতুন শিক্ষা, নতুন সাহিত্য, নতুন সামাজিক আদর্শ ও রীতিনীতির। এই নতুনের মধ্যেই বাংলায় ‘রেনেসাঁ' বা নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে। এভাবেই উপমহাদেশে তথা বাংলায় প্রথম নবজাগরণের বা রেনেসাঁর জন্ম। ফলে ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা হয়ে ওঠে আধুনিক চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রস্থল । ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বাঙালি পরিণত হয় পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহকে । বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা প্রত্যাখ্যান করে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে আধুনিক মানুষে পরিণত হন । এই নব ভাবধারা প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছুসংখ্যক উদারচেতা প্রশাসকেরও অবদান রয়েছে। তাঁরা দেশি ভাষা-সাহিত্যের উন্নতির জন্য ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছেন। হেস্টিংস, অ্যালফিনস্টোন, ম্যালকম মনরো, মেটকাফ প্রমুখ ইংরেজ প্রশাসক ভারতবাসীকে পাশ্চাত্য ভাবধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনে উজ্জীবিত করাকে তাঁদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব কর্তব্য বলে মনে করতেন । তাছাড়া খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাও আধুনিক শিক্ষার ভাবধারা প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় ।

Content added || updated By

বাংলার নবজাগরণের স্রষ্টা ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৭৭৪ সালে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে তাঁর জন্ম । অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন রাজা রামমোহন রায় । বিশেষ করে আরবি, ফারসি, উর্দু, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় তিনি অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বেদান্তসূত্র ও বেদান্তসারসহ উপনিষদের অনুবাদ প্রকাশ করেন । তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে আছে তুফাতুল মুজাহহিদদীন (একেশ্বরবাদ সৌরভ), মনজারাতুল আদিয়ান (বিভিন্ন ধর্মের উপর আলোচনা), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালি ইত্যাদি। তাছাড়া তিনি সম্বাদ কৌমুদী, মিরাতুল আখবার ও ব্রাহ্মণিকাল ম্যাগাজিন নামে তিনটি পত্রিকার প্রকাশকও ছিলেন।

আধুনিক ভারতের রূপকার রাজা রামমোহন তৎকালীন সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন । নিজের চিন্তাধারার আলোকে নতুন সমাজ গঠনে প্রয়াসী হন। তিনি হিন্দু সমাজের সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা ও অন্যান্য কুসংস্কার দূর করতে প্রচেষ্টা চালান। তাছাড়া তিনি সব কুসংস্কার দূর করে আদি একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে হিন্দুধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। হিন্দুধর্মের সংস্কার তথা নিজ ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে আত্মীয় সভা নামে একটি সমিতি গঠন করেন। ১৮২৮ সালে ২০শে আগস্ট তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন । এর পরে ব্রাহ্মসমাজের উপাসনালয় স্থাপন করেন । তাঁর ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের ধর্মীয় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে । শুধু সামাজিক আর ধর্মীয় বিষয় নয়, শিক্ষা বিস্তারেও তাঁর অবদান ছিল । তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষার । এ কারণে তিনি নিজে সংস্কৃত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ১৯২৩ সালে প্রস্তাবিত সরকারি সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন । রাজা রামমোহন ১৮২২ সালে কোলকাতায় 'অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল' প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ইংরেজি, দর্শন, আধুনিক বিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। এ দেশের মানুষকে সংস্কৃত শিক্ষার বদলে আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লেখেন । তাছাড়া ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ১ লক্ষ টাকা তিনি সংস্কৃত ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যয় না করে আধুনিক শিক্ষায় ব্যয় করার জন্যও আবেদন করেন ।

১৮৩৩ সালে ভারতীয় রেনেসাঁর স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয় । তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৮৩৫ সালে তাঁর স্বপ্ন সফল হয় । ভারতীয়দের পাশ্চাত্য ভাষা ইংরেজিতে শিক্ষা দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।

Content added By
গৌড়ীয় ব্যাকরণ
ভাষা ও ব্যাকরণ
বর্ণ পরিচয়
সরল বাংলা ব্যাকরণ

ডিরোজি ও ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্ট

হেনরি লুই ডিরোজিও ১৮০৯ সালের ১৮ই এপ্রিল কোলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ছিলেন বাঙালি। ডিরোজিও ইংরেজি শিক্ষার স্কুল ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা একাডেমিতে পড়ালেখা শুরু করেন । স্কুলে প্রধান শিক্ষক ড্রামন্ড ছিলেন প্রগতিবাদী, সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ মানবতাবাদী অত্যন্ত নিষ্ঠাবান শিক্ষক । এই শিক্ষকের আদর্শ ডিরোজিওকে তাঁর শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রভাবিত করে রেখেছিল। যে কারণে পরবর্তীকালে তিনি হতে পেরেছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি । তিনি ছিলেন ‘রেনেসাঁ' যুগে বাঙালি যুব সমাজের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী “ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলনের প্রবক্তা । বয়সে তরুণ হলেও তিনি ইতিহাস, ইংরেজি, সাহিত্য, দর্শন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দূরদৃষ্টি, বাগ্মিতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা তৎকালীন তরুণ সমাজকে ব্যাপক প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে ছিল রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের ধারা। দৃঢ়ভাবে সে ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল হিন্দু কলেজের প্রতিভাবান ছাত্রবৃন্দ, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের মাধ্যমে। যার নেতৃত্বে ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুইস ডিরোজিও। তিনি তাঁর ছাত্র-অনুসারীদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার শিক্ষা দেন । ইয়াং বেঙ্গল আন্দোলনের সদস্যরা এ দেশবাসীকে বারবার এ কথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত ও শোষিত হচ্ছে। এ কারণে এই তরুণরা ভারতবাসীর স্বার্থবিরোধী সব কাজের ঘোর বিরোধিতা করেছে । যেমন- প্রেস আইন, মরিশাসে ভারতীয় শ্রমিক রপ্তানি, ভারতবাসীর স্বার্থের প্রতি উদাসীন ১৮৩৩ সালের চার্টার আইন এদের দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে ।

তরুণ সমাজের পুরোনো ধ্যান ধারণা পাল্টে দিতে ডিরোজিও কর্তৃক ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একাডেমি অ্যাসোসিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । একাডেমিতে তরুণদের এই শিক্ষা দেওয়া হয় যে, যুক্তিহীন বিশ্বাস হলো মৃত্যুর সমান । নতুন চিন্তাধারায় প্রভাবিত তরুণরা সনাতনপন্থী হিন্দু এবং গোঁড়াপন্থী খ্রিষ্টানদের ধর্মবিশ্বাসেও আঘাত হানে । ফলে এরা ডিরোজিও এবং তার একাডেমির সদস্যদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয় । ১৮৩০ সালে ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘পার্থেনন' নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে । এতে সমাজ, ধর্ম, বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করে দেয় । তিনি ১৮৩১ সালে 'হিসপাবাস' নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা এবং ‘ইস্ট ইন্ডিয়া' নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন । ঐ বছরই ডিসেম্বরে মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

মৃত্যুর পরও তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলতে থাকে তাঁর হাতে গড়া অনুসারীরা । ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারী ছাত্ররা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ সিকদার, প্যারিচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি প্রমুখ । মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ছাত্র না হলেও তাঁর আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন । ডিরোজিওর অনুসারীদের আন্দোলন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও প্রভাবিত করেছিল।

Content added By

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

পাণ্ডিত্য, শিক্ষা বিস্তার, সমাজ সংস্কার, দয়া ও তেজস্বিতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন উনিশ শতকের বাংলায় একক ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রজ্ঞা ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঋষির মতো, শৌর্য ছিল ইংরেজদের মতো, আর হৃদয় ছিল বাংলার কোমলমতি মায়েদের মতো । এই অসাধারণ যুগ প্রবর্তক মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তিনি তাঁর তেজস্বিতা, সত্যনিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন তাঁর দরিদ্র ব্রাহ্মণ পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে; আর হৃদয়ের মমত্ববোধ তাঁর মা ভাগবতী দেবীর কাছ থেকে। দারিদ্র্যের কারণে রাতে বাতি জ্বালিয়ে পড়ার ক্ষমতা ছিল না । ফলে শিশু ঈশ্বরচন্দ্র সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তার গ্যাস বাতির নিচে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করতেন। তিনি ইংরেজি সংখ্যা গণনা শিখেছিলেন তাঁর বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে কোলকাতায় আসার সময়, রাস্তার পাশের মাইল ফলকের সংখ্যার হিসাব গুনতে গুনতে।

অসাধারণ মেধা আর অধ্যবসায়ের গুণে তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত, স্মৃতি, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ঐ বয়সে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতের দায়িত্ব লাভ করেন। একই সঙ্গে তিনি বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করেন ।
কর্মজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চায়ও মনোযোগী হন । বাংলা ভাষায় উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তকের অভাব দেখে তিনি গদ্যসাহিত্য রচনা শুরু করেন। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে নবজীবন দান করেন। এ জন্য তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। শিশুদের লেখাপড়া সহজ করার জন্য তিনি রচনা করেন বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষাকে সহজ করার জন্য তিনি ব্যাকরণের উপক্রমণিকা রচনা করেন। তাছাড়া তিনি অনেক গ্রন্থের অনুবাদও করেছেন।

শুধু সাহিত্য নয়, শিক্ষা বিস্তারে তাঁর কৃতিত্ব অসাধারণ। সংস্কৃত শিক্ষার সংস্কার, বাংলা শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন এবং নারীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা তাঁর অক্ষয় কীর্তি। তাছাড়া স্কুল পরিদর্শক থাকাকালে গ্রামে-গঞ্জে ২০টি মডেল স্কুল, ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোর ইমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন । এখন এটি বিদ্যাসাগর কলেজ নামে খ্যাত । তিনি একজন সফল সমাজ-সংস্কারকও ছিলেন। দেশে প্রচলিত নানা ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। তিনি কন্যাশিশু হত্যা, বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার কারণে ১৮৫৬ সালে গভর্নর জেনারেলের সম্মতিক্রমে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় ।

বিদ্যাসাগর দান-দাক্ষিণ্যের জন্য খ্যাত ছিলেন । এ কারণে তাঁকে দয়ার সাগরও বলা হতো । যথেষ্ট সচ্ছল না হলেও বহু অনাথ ছাত্র তাঁর বাসায় থেকে লেখাপড়া করতো। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের চরম অর্থকষ্টের সময়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন তরুণ বয়সে বিদ্যাসাগরের অর্থে লেখাপড়া করেছেন । তাঁর মাতৃভক্তি ছিল অসাধারণ। মায়ের ইচ্ছার তিনি গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । মারের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য তিনি একবার ভরা বর্ষার গভীর রাতে দামোদর নদ পার হয়ে বাড়ি যান ।

এই সমাজ সেবক মহাজ্ঞানী ১৮৯১ সালে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

Content added By

হাজী মূহম্মদ মহসীন

হাজী মুহম্মদ মহসীন ১৭৩২ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম ছিল মুহম্মদ ফয়জুল্লাহ। মায়ের নাম ছিল জয়নাব খানম । তাদের আদি নিবাস ছিল পারস্যে। হাজী মুহম্মদ মহসীনের পূর্বপুরুষ ভাগ্য অন্বেষণে হুগলী শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। মহসীনের শিক্ষাজীবন শুরু হুগলীতে। তাঁর গৃহশিক্ষক আগা সিরাজি ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি তাঁর কাছে আরবি-ফারসি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ভোলানাথ ওয়াদ নামে একজন সঙ্গীতবিদের কাছে সঙ্গীত সেতার বাজানো শেখেন। তাঁর উচ্চশিক্ষা শুরু হয় মুর্শিদাবাদে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হুগলী ফিরে আসেন এবং ১৭৬২ সালে দেশ ভ্রমণে বের হন। তিনি মক্কা, মদিনা গমন করেন এবং পবিত্র হজ পালন করেন। আরব,  মিশর, পারস্য ভ্রমণ করে তিনি সাতাশ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি এবং ইতিহাস ও বীজগণিতে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ১৮০৩ সালে তাঁর একমাত্র বোনের মৃত্যু হলে নিঃসন্তান বোনের বিশাল সম্পত্তির মালিক হন তিনি। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তখন বাংলার মুসলমানদের ছিল চরম দুর্দিন। অর্থ ব্যয় করে লেখাপড়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তিনি তাঁর সমুদয় অর্থ শিক্ষা বিস্তার চিকিৎসা এবং দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয় করেন।

তিনি হুগলীতে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর প্রভৃতি স্থানের মাদ্রাসার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ দান করেন। মৃত্যুর ছয় বছর পূর্বে ১৮০৬ সালে একটি ফান্ড গঠন করে জনহিতকর কার্যে সমস্ত সম্পত্তি দান করেন । মহসীন ফান্ডের অর্থে তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৩৬ সালে হুগলী মহসীন ফান্ড, হুগলী দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ১৮৪৮ সালে হুগলীতে ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া হুগলী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে মাদ্রাসা ও ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহসীন ফান্ডের বৃত্তির অর্থে হাজার হাজার মুসলমান তরুণ উচ্চ-শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। এর মধ্যে বাংলার মুসলমান সমাজকে যাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষার পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের অগ্রদূত সৈয়দ আমির আলীও ছিলেন। এভাবে তিনি তাঁর মৃত্যুর পরও বাঙালি মুসলমানদের জন্য শিক্ষার পথ সুগম করে যান। এই দানশীল বিদ্যানুরাগী মহাপুরুষ ১৮১২ সালে ২৯শে নভেম্বর হুগলীতে পরলোকগমন করেন ।

Content added By

আবদুল লতিফ ১৮২৮ সালে ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি প্রথমে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল এবং পরে কোলকাতা মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করেন। ১৮৪৯ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যোগদান করেন। ১৮৭৭ সালে তাকে কোলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত করা হয়। ১৮৮৪ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তাঁর কৃতিত্বের জন্য সরকার তাঁকে প্রথমে খান বাহাদুর ও পরে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করে। 

তিনি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের প্রয়োজন এবং তাদের ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তাই তিনি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টা চালান। এই উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য তিনি ১৮৫৩ সালে 'মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে ইংরেজি শিক্ষার সুফল' শীর্ষক এক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় কোলকাতা মাদ্রাসায় অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ খোলা হয় । সেখানে উর্দু, বাংলা শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে মুসলমান ছাত্রদের সমস্যার কথা তিনি সরকারের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর প্রচেষ্টায় হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর করা হলে মুসলমান ছাত্ররা সেখানে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়। তিনি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। আবদুল লতিফের প্রচেষ্টার কারণে ১৮৭৩ সালে মহসীন ফান্ডের টাকা শুধু বাংলার মুসলমানদের শিক্ষায় ব্যয় হবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করা হয়। আবদুল লতিফের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে ১৮৬৩ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি বা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ।

 

নওয়াব আবদুল লতিফের সারা জীবনের কর্মের মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি :

  • মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ইংরেজ সরকারের বিদ্বেষ ভাব দূর করা;
  • মুসলমান সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
  • হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করা ।

 

Content added By

উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি হলেন সৈয়দ আমির আলি। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নতি করতে চেয়েছেন । পাশাপাশি তিনি তাদের রাজনৈতিকভাবেও সচেতন করতে চেয়েছেন। সৈয়দ আমির আলি ১৮৪৯ সালে হুগলীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ও বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন । ১৮৭৩ সালে লন্ডনের লিংকল ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফেরেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৮৯০ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৯ সালে তিনি লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন।

বাংলা তথা ভারতে তিনিই প্রথম মুসলমান নেতা, যিনি বিশ্বাস করতেন মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন থাকা প্রয়োজন । তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা এবং তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন থাকা প্রয়োজন । এই উদ্দেশে তিনি ১৮৭৭ সালে কোলকাতায় ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন' নামে একটি সমিতি গঠন করেন । তিনি পত্র-পত্রিকায় শিক্ষা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করেন। ফলে ১৮৮৫ সালে সরকার মুসলমানদের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য কতকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । এ কারণে তিনি ১৮৮৪ সালে কোলকাতায় মাদ্রাসায় কলেজ পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষা এবং করাচিতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেন।

তাঁর বিখ্যাত দুইটি গ্রন্থ 'The Spirit of Islam' এবং 'A Short History of the Saracens'-এ ইসলাম ধর্মের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও ইসলামের অতীত গৌরবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আধুনিক ভারতের উন্নতির জন্য হিন্দু-মুসলামান উভয় সম্প্রদায়ের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন । তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানান। ১৯১২ সালে তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন । সৈয়দ আমির আলি নারী অধিকারের বিষয়েও সচেতন ছিলেন ।
 

Content added By

বিশ শতকের শুরুতে যখন ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বলছে, বাঙালি মুসলমান মেয়েরা তখনও পিছিয়ে ছিল। মুসলমান সমাজের মেয়েরা সব অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। লেখাপড়া শেখা তাদের জন্য একরকম নিষিদ্ধই ছিল। সমাজ ধর্মের নামে তাদের রাখা হতো পর্দার আড়ালে গৃহবন্দী করে । মুসলমান মেয়েদের এই বন্দিদশা থেকে যিনি মুক্তির ডাক দিলেন, তাঁর নাম, বেগম রোকেয়া। ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলি সাবের ।

মায়ের নাম মোসাম্মৎ বাহাতননেসা সাবেরা চৌধুরানি। ঐ অঞ্চলে সাবের পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং রক্ষণশীল। মেয়েরা ছিল খুবই পর্দানশিন। বেগম রোকেয়া তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং বড় বোন করিমুন্নেসার কাছে শিক্ষা লাভ করেন। তাঁকে পড়াশোনা করতে হতো গভীর রাতে, যাতে বাড়ির লোক টের না পায়। বড় ভাইয়ের একান্ত উৎসাহে তিনি উর্দু, আরবি, ফারসি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। স্কুলে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব না হলেও তিনি বাংলা ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন । কিশোর বয়স থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন ।

সাহিত্যচর্চার বিষয়বস্তুও ছিল নারী সমাজকে নিয়ে । তিনি সমাজের কুসংস্কার, নারী সমাজের অবহেলা-বঞ্চনার করুণ চিত্র নিজ চোখে দেখেছেন। যা উপলব্ধি করেছেন, তা-ই তিনি তাঁর লেখার মধ্যে তুলে ধরেছেন। সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন নারীদের করুণ দশা, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নমুনা। তাঁর “অবরোধবাসিনী', 'পদ্মরাগ', 'মতিচূর', 'সুলতানার স্বপ্ন' প্রভৃতি গ্রন্থে সে চিত্র ফুটে উঠেছে । বিবাহিত জীবনে তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে জ্ঞানচর্চার উৎসাহ লাভ করেছিলেন । স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর জীবনের বাকি সময়টা নারী শিক্ষা আর সমাজসেবায় ব্যয় করেন । তিনি স্বামীর নামে ভাগলপুরে একটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন । ১৯১১ সালে তিনি কোলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল উর্দু প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেন । ১৯৩১ সালে এটি উচ্চ ইংরেজি গালর্স স্কুলে উন্নীত হয় । মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন ।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৬ সালে কোলকাতায় আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম (মুসলিম মহিলা সমিতি ) প্রতিষ্ঠা করেন । নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্বে সমিতি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার মনে নারীর প্রতি অত্যাচার ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ছিল তীব্র ক্ষোভ ও বিদ্রোহের সুর। তিনি কর্মের মধ্যে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন । ১৯৩২ সালে এই মহীয়সী নারী কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন । 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion